মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা বহিরাগত ক্ষতিকর বস্তু (অ্যান্টিজেন) থেকে দেহকে রক্ষা করে। এর মূল লক্ষ্য হলো 'self' (নিজস্ব) এবং 'non-self' (পার্শ্বীয়) কোষ বা বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করা এবং non-self বস্তুকে নিষ্ক্রিয় বা ধ্বংস করা।

প্রতিরক্ষার প্রকারভেদ

সহজাত প্রতিরক্ষা (Innate Immunity)

জন্মগতভাবে প্রাপ্ত, অনির্দিষ্ট (non-specific) এবং দ্রুত কার্যকরী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর নিয়ে গঠিত। এর কোনো স্মৃতি কোষ নেই।

অর্জিত প্রতিরক্ষা (Acquired Immunity)

জন্মের পর জীবাণুর সংস্পর্শে বা টিকার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটি সুনির্দিষ্ট (specific) এবং স্মৃতি-নির্ভর। এটি তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর।

সহজাত ও অর্জিত প্রতিরক্ষার পার্থক্য
বৈশিষ্ট্যসহজাত প্রতিরক্ষাঅর্জিত প্রতিরক্ষা
নির্দিষ্টতাঅনির্দিষ্টসুনির্দিষ্ট
স্মৃতিস্মৃতি কোষ থাকে নাস্মৃতি কোষ তৈরি হয়
কার্যকারিতার সময়দ্রুত (মিনিট থেকে ঘণ্টা)বিলম্বিত (কয়েক দিন)
স্তরপ্রথম ও দ্বিতীয়তৃতীয়

ইমিউন তন্ত্রের কোষসমূহ

ফ্যাগোসাইটিক কোষ

  • নিউট্রোফিল: রক্তে সর্বাধিক (৬০-৭০%)। এরা 'Microphage' নামেও পরিচিত। ফ্যাগোসাইটোসিসের পর এরা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে পুঁজ (pus) তৈরি করে।
  • ম্যাক্রোফেজ: মনোসাইট থেকে রূপান্তরিত বৃহৎ কোষ। এরা জীবাণু ভক্ষণের পাশাপাশি অ্যান্টিজেন উপস্থাপনকারী কোষ (APC) হিসেবে কাজ করে এবং ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে।
  • ডেনড্রাইটিক কোষ: সবচেয়ে শক্তিশালী APC, যা T-কোষকে সক্রিয় করে। ত্বকে এদের 'ল্যাঙ্গারহ্যান্স কোষ' বলে।

লিম্ফোসাইট

  • B-লিম্ফোসাইট: অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়। রসনির্ভর প্রতিরক্ষা প্রদান করে।
  • T-লিম্ফোসাইট: থাইমাসে পরিণত হয়। কোষভিত্তিক প্রতিরক্ষা প্রদান করে। প্রকারভেদ: Helper T-cell (CD4+), Cytotoxic T-cell (CD8+), Memory T-cell।
  • সহজাত ঘাতক কোষ (NK Cell): সহজাত প্রতিরক্ষার অংশ। পারফোরিন ও গ্রানজাইম ব্যবহার করে কোষ ধ্বংস করে।

অন্যান্য কোষ

  • মাস্ট কোষ: যোজক কলায় অবস্থিত। হিস্টামিন ও হেপারিন নিঃসরণ করে প্রদাহ ও অ্যালার্জিক বিক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
  • বেসোফিল: রক্তে সবচেয়ে কম। মাস্ট কোষের অনুরূপ কাজ করে।
  • ইউসিনোফিল: কৃমি বা পরজীবী সংক্রমণ এবং অ্যালার্জিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।

লিম্ফয়েড অঙ্গসমূহ

প্রাথমিক লিম্ফয়েড অঙ্গ

যেখানে লিম্ফোসাইট উৎপন্ন ও পরিণত হয়।

  • অস্থিমজ্জা (Bone Marrow)
  • থাইমাস গ্রন্থি (Thymus)

গৌণ লিম্ফয়েড অঙ্গ

যেখানে পরিণত লিম্ফোসাইটগুলো অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে এসে সক্রিয় হয়।

  • প্লীহা (Spleen)
  • লসিকা গ্রন্থি (Lymph Nodes)
  • MALT (Mucosa-Associated Lymphoid Tissue): টনসিল, অ্যাপেনডিক্স, পেয়ার'স প্যাচ ইত্যাদি।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্তর বিস্তারিত

প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর

১. ত্বক: কেরাটিনযুক্ত 'স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম' স্তরটি অভেদ্য। সিবেসিয়াস গ্রন্থির 'সেবাম' ও ঘর্মগ্রন্থির ঘাম (ল্যাকটিক এসিড) ত্বকের pH অম্লীয় (3-5) রাখে। এতে লাইসোজাইম এনজাইম থাকে।

২. মিউকাস ঝিল্লি ও সিলিয়া: শ্বসনতন্ত্রের মিউকাস জীবাণুকে আটকায় এবং সিলিয়া তাদের বাইরে বের করে দেয়।

৩. রাসায়নিক প্রতিবন্ধক: অশ্রু ও লালার লাইসোজাইম, শুক্রাণুর স্পারমিন, কানের সেরুমেন এবং পাকস্থলীর HCl (pH 1.5-3.5)।

দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর

১. ফ্যাগোসাইটোসিস: জীবাণু ভক্ষণের প্রক্রিয়া। ধাপ: Chemotaxis, Adherence, Ingestion, Digestion, Exocytosis।

২. প্রদাহ (Inflammation): এর ৪টি প্রধান লক্ষণ - Rubor (লাল হওয়া), Calor (উত্তাপ), Tumor (ফোলা), Dolor (ব্যথা)।

৩. জ্বর: পাইরোজেন (যেমন: Interleukin-1) হাইপোথ্যালামাসকে উদ্দীপ্ত করে দেহের তাপমাত্রা বাড়ায়।

৪. কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম: প্রায় ৩০টি প্লাজমা প্রোটিনের সমষ্টি যা প্রদাহ, অপসোনাইজেশন এবং সরাসরি জীবাণু ধ্বংস করে (MAC গঠন)।

৫. ইন্টারফেরন: ভাইরাস আক্রান্ত কোষ থেকে নিঃসৃত গ্লাইকোপ্রোটিন যা পার্শ্ববর্তী কোষগুলোকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম করে তোলে।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অণুসমূহ

MHC (Major Histocompatibility Complex)

কোষঝিল্লিতে অবস্থিত একগুচ্ছ প্রোটিন যা অ্যান্টিজেন প্রদর্শনে সাহায্য করে। মানুষের ক্ষেত্রে একে HLA (Human Leukocyte Antigen) বলে।

  • MHC-I: দেহের সকল নিউক্লিয়াসযুক্ত কোষে থাকে। এরা অভ্যন্তরীণ অ্যান্টিজেন (ভাইরাস, টিউমার) ঘাতক T-কোষের (CD8+) কাছে প্রদর্শন করে।
  • MHC-II: শুধুমাত্র APC-দের (ম্যাক্রোফেজ, B-কোষ, ডেনড্রাইটিক কোষ) মধ্যে থাকে। এরা বহিরাগত অ্যান্টিজেন সহায়ক T-কোষের (CD4+) কাছে প্রদর্শন করে।

সাইটোকাইন (Cytokines)

প্রতিরক্ষা কোষগুলোর মধ্যে রাসায়নিক বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে। যেমন:

  • ইন্টারলিউকিন (Interleukins): IL-1, IL-2 ইত্যাদি কোষের সক্রিয়করণ ও সংখ্যাবৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  • ইন্টারফেরন (Interferons): ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যপ্রক্রিয়া

ধাপ ১: অ্যান্টিজেন শনাক্তকরণ ও উপস্থাপন

APC জীবাণুকে ভক্ষণ করে এর অংশবিশেষ MHC-II প্রোটিনের সাহায্যে প্রদর্শন করে।

ধাপ ২: সহায়ক T-কোষ (CD4+) সক্রিয়করণ

সহায়ক T-কোষ APC-এর প্রদর্শিত অ্যান্টিজেনকে শনাক্ত করে। APC তখন IL-1 নিঃসরণ করে T-কোষটিকে সক্রিয় করে।

ধাপ ৩: B ও ঘাতক T (CD8+) কোষের বিস্তার

সক্রিয় সহায়ক T-কোষ IL-2 নিঃসরণ করে, যা B-কোষ ও ঘাতক T-কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি (Clonal Selection) ঘটায়।

ধাপ ৪: জীবাণু ধ্বংস ও স্মৃতি গঠন

  • রসনির্ভর সাড়া: সক্রিয় B-কোষ থেকে প্লাজমা কোষ তৈরি হয়, যা অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে।
  • কোষভিত্তিক সাড়া: ঘাতক T-কোষ (CD8+) MHC-I যুক্ত আক্রান্ত কোষকে সরাসরি ধ্বংস করে।
  • স্মৃতিকোষ (Memory Cells): কিছু B ও T কোষ স্মৃতিকোষে পরিণত হয়।

মুখ্য ও গৌণ সাড়া (Primary & Secondary Response)

অর্জিত প্রতিরক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো স্মৃতি। এর উপর ভিত্তি করে দুই ধরনের সাড়া দেখা যায়।

বৈশিষ্ট্যমুখ্য সাড়াগৌণ সাড়া
সংঘটনঅ্যান্টিজেনের সাথে প্রথমবার সাক্ষাৎএকই অ্যান্টিজেনের সাথে ২য় বা পরবর্তী সাক্ষাৎ
সময়বিলম্বিত (৫-১০ দিন)দ্রুত (১-৩ দিন)
তীব্রতাদুর্বলঅনেক বেশি শক্তিশালী
প্রধান অ্যান্টিবডিপ্রথমে IgM, পরে IgGপ্রধানত IgG (বেশি পরিমাণে)
কারণnaive লিম্ফোসাইট থেকে শুরু হয়স্মৃতিকোষের (Memory cell) কারণে হয়

অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি

অ্যান্টিজেন (Antigen)

এর যে অংশের সাথে অ্যান্টিবডি যুক্ত হয় তাকে এপিটোপ (Epitope) বলে।

  • হ্যাপ্টেন: অপূর্ণাঙ্গ অ্যান্টিজেন, যা বাহক প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে সক্ষম হয়।

অ্যান্টিবডি (Immunoglobulin)

এর ২টি ভারী (Heavy) ও ২টি হালকা (Light) শৃঙ্খল ডাই-সালফাইড বন্ড দ্বারা যুক্ত। অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত হওয়া অংশকে প্যারাটোপ (Paratope) বলে।

অ্যান্টিবডির প্রকারভেদ ও কাজ (GAMED)

প্রকারপরিমাণকাজ
IgG~৭৫%একমাত্র অ্যান্টিবডি যা অমরা অতিক্রম করতে পারে। গৌণ সাড়াদানে প্রধান।
IgA~১৫%মায়ের দুধ, লালা, অশ্রু ও শ্লেষ্মায় পাওয়া যায় (ডাইমার)।
IgM~৫-১০%আকারে সবচেয়ে বড় (পেন্টামার)। মুখ্য সাড়াদানে প্রথম তৈরি হয়।
IgE~০.০১%মাস্ট কোষ ও বেসোফিলের গায়ে যুক্ত থাকে। অ্যালার্জিক বিক্রিয়ার জন্য দায়ী।
IgD<১%B-কোষের ঝিল্লিতে রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে।

ভ্যাকসিন বা টিকা

ভ্যাকসিন হলো একটি জৈব রাসায়নিক বস্তু যা কৃত্রিম সক্রিয় অর্জিত প্রতিরক্ষা (Artificial Active Acquired Immunity) তৈরি করে। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন।

টিকার প্রকারভেদ

শক্তি হ্রাসকৃত (Live-attenuated)

মাম্পস, মিজলস, রুবেলা (MMR), যক্ষ্মা (BCG), পোলিও (OPV), জলবসন্ত, টাইফয়েড

মৃত বা নিষ্ক্রিয় (Inactivated)

র‍্যাবিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও (IPV), কলেরা, হেপাটাইটিস-এ

সাব-ইউনিট (Subunit)

হেপাটাইটিস-বি (HBV), হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV)

টক্সয়েড (Toxoid)

ডিপথেরিয়া, টিটেনাস (ধনুষ্টংকার)

কনজুগেট (Conjugate)

হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি (Hib)